রমা গুপ্তর তিনটি কবিতা --
অশ্বত্থামার অনুশোচনা
আমি অশ্বত্থামা , দ্রোণপুত্র কৃপির স্নেহের সন্তান,
সপ্ত চিরঞ্জীবির এক চিরঞ্জীবি দৈববলে বলিয়ান।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আমিই যে শেষ সেনাপতি,
আসুরিক আচরণে আমার আজ এই অধোগতি।
পিতা আর মিত্র দুর্যোধন যবে হলেন যুদ্ধে হত,
প্রতিশোধ স্পৃহা হলো মনে প্রবল জাগ্ৰত।
জ্বালামুখী হতে নির্গত উষ্ণ তরলের ন্যায় মন,
ক্রুব্ধ আমি পান্ডব বংশের ধ্বংস করিলাম পণ।
ছদ্মবেশে এক রাতে গিয়ে পান্ডব শিবিরে,
ঘুমের মধ্যে বধিলাম দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রেরে।
ভেবেছিলাম পঞ্চপান্ডবে করেছি নিধন,
ভুল ভাঙ্গিল যখন সন্মূখে দেখিলাম পান্ডবগণ।
আচম্বিতে বিস্মিত হয়েও সেদিন করেছিলাম নিজেকে সম্বরণ।
ক্রোধিত পান্ডবগণ বলেন গোপনে কেন করিলে দ্রৌপদীর পুত্রনিধন !
পাষন্ডের মত বলেছি সেদিন পান্ডব বংশের ধ্বংস করেছি পণ।
বংশের বাতি দিতে তাইতো রাখি নাই একজন।
উত্তরার গর্ভ সংবাদ শুনে ভীমসেনের মুখে,
রোষের অনলে পুড়ে প্রতিহিংসা জাগে বুকে।
উন্মত্ত হয়ে গর্ভনষ্ট লাগি নিক্ষেপিলাম ব্রহ্মাস্ত্র ,
তাই দেখে পান্ডবগণ হলেন ভীষণ ত্রস্ত।
মোর পিতা আর সখাকে হত্যা করেছিল ছলিয়া,
শোকে তাই একাজ করেছি উন্মত্ত হইয়া।
কৃষ্ণ আসিয়া কহেন ব্রহ্মাস্ত্র ফিরায়ে লও,
ভ্রূণ হত্যা মহাপাপ নিস্তার নাহি পাও।
দুরাচারী কংস,রাবনও করে নাই এ কাজ,
দ্রোণ পুত্র হয়ে তুমি পিতার রাখিলে না লাজ।
এ মহাপাপ যে ক্ষমারও অযোগ্য,
ব্রহ্মাস্ত্র ফিরায়ে আনি কর ন্যায় কার্য।
ক্ষমা তো চাই নি সেদিন, হয়েছি দম্ভিত,
ক্রোধিত হয়ে কৃষ্ণ করেন দন্ডিত।
কপাল হতে চক্র দ্বারা তুলে নিলেন মোর মণি,
অভিশাপ দিলেন সর্বাঙ্গে ঘা লয়ে বাঁচিয়া থাকিবে তুমি।
পুঁচ রক্ত পড়িবে সদা ,লোকে কাছে নাহি যাবে,
জল যাচি নাহি পাবে আহার না জুটিবে।
সেই হতে আজও আমি ভ্রমিতেছি একা,
ঘৃণা ভরে লোকে দেখে নাহি স্বজনের দেখা।
ব্রহ্মাস্ত্র ফিরাইবার শিক্ষা দেন নাই পিতা,
ফিরাইতে ইচ্ছা হইলেও সেদিন পারি নাই তা।
অর্ধশিক্ষা ছিল মোর সেদিনের ভুল,
অর্ধশিক্ষা ভয়ঙ্কর অহংকারের মূল।
মরিব না অহংকার ছিল মোর মনে,
অমরত্ব দিলেন কৃষ্ণ আজ মরি প্রতিক্ষণে।
কঙ্কালসার দেহ মোর দুর্গন্ধে ভরা,
ন্যুব্জ হয়ে চলি আমি সারা দেহে জরা।
ব্রহ্মাস্ত্রে বিনাশ হয়েছিল উত্তরার গর্ভ সন্তান,
কৃষ্ণ তার পুণ্য বলে পুনঃ সঞ্চারীলেন প্রাণ।
পরবর্তিতে সে সন্তান আসিল ধরনীতে,
পরিক্ষীৎ নামে খ্যাত হলেন মহাভারতে।
শুনিয়া সে সংবাদ শান্তি হলো মনে,
বন্দিলাম মনে মনে শ্রীকৃষ্ণ চরণে।
সীমাহীন নৈরাজ্যতা
বর্তমানে সংকীর্ণতা আর স্বার্থপরতায় সমাজ জীবন গিয়েছে ভরে,
বিষন্ন আবহে সভ্যতা তাই আজ নিভৃতে গুমরে মরে।
আগ্ৰাসী মনোভাব কেবলই বিধ্বংসে আনন্দ উল্লাস,
বিবেক মানবিকতা দিয়ে বিসর্জন বর্বরতায় বিলাস।
বিষবাষ্পে ভরেছে গগন মলিনতা মনের ঘরে,
স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত সবাই চেনেনা আপন পরে।
বিকিয়েছে মনুষত্ব স্তাবকতাই যেন প্রগতির মান,
দস্তুর এখন যোগ্যের অপমান, অযোগ্যের স্তুতিগান।
বিশ্বাস করে লুকোচুরি খেলা মুখোশের আড়ালে।
মান হুঁশ সব লুপ্ত হয়েছে রাহুর করাল গ্ৰাসে,
সীমাহীন নৈরাজ্যতায় প্রতিবাদ নেই কোনো, মানুষ নীরব ত্রাসে।
বীরবাহু বধ
শোকাগ্ৰস্ত লঙ্কাপতি বীরবাহু তরে
বিষাদে নিঃশ্বাস ছাড়ে বলে ক্ষীণ স্বরে
হে বীর লঙ্কার তুমি কুলের প্রবর
রাক্ষস কুলেতে জন্ম প্রতাপ প্রখর।
স্তম্ভিত হয়েছে রাম মনে খুশি তাই,
তোমার মতন বীর বুঝি দেখে নাই।
হায় পুত্র বীরবাহু বাহুবলি কত
হৃদয়েতে বজ্র যেন হানে ব্যথা শত।
ওরে ভগ্নী সূর্পনখা! তোর অপমানে
ক্রোধান্বিত হয়ে কেন, গেলাম সে স্থানে!
মতিভ্রম হলো শেষে ছদ্মবেশ ধরে
রাম লক্ষ্মী হরণের পাপ স্পর্শ করে।
অন্তরেতে হাহাকার নেই পরিসীমা
হৃদি বৃন্তে ফোটা ফুল স্নেহ মধুরিমা,
কেউ যদি নেয় ছিঁড়ে রক্ত ক্ষরণেতে
নিস্তেজ হয় যে দেহ শোক আবহেতে।
যন্ত্রণা অনলে পুড়ে মরি আমি। যাও
মন্দোদরী, চিত্রাঙ্গদা কে সান্ত্বনা দাও।
বাক্যহীনা চিত্রাঙ্গদা বসে পুত্র ধরে
মন্দোদরী গেলে কাছে বলে সকাতরে,
দিয়েছি সন্তান যবে লঙ্কেশের কাছে মনে মনে জানি পুত্র সুরক্ষিত আছে।
মেনে নিতে পারিনা যে এই অঘটন,
হৈমপুরী রক্ষা হেতু বধ মম ধন।
ততক্ষণে সভা মধ্যে প্রজাদের ভীড়
বীরবাহু বধে সব বিষণ্ণ গম্ভীর।
লঙ্কাপতি এসেছেন ধীর পদে অতি,
চিত্রাঙ্গদাকে বলেন শান্ত রাখো মতি।
বিভীষণ করেছে যে, মৈত্রী বৈরী সাথে
লঙ্কা রক্ষা ভার দিই বীরবাহু হাতে।
মোক্ষম সমরে রক্ষে প্রাসাদ লঙ্কার
কুলরত্ন বীরবাহু রাজ্য অলঙ্কার।
ক্রন্দন করোনা প্রিয়ে হৈমপুরী ধনি,
সমরেতে জিতেছে সে বীর চূড়ামণি।
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে চিত্রাঙ্গদা বলেন, রতন
দিয়েছিল দেব মোরে, রক্ষার্থে যতন
আপনাকে দিই, পাখি যেমন শাবকে
রাখে লুকিয়ে কোটরে, বলুন পুত্রকে
রেখেছেন কোন্ খানে? প্রজাগনে রক্ষা
নৃপ ধর্ম। তবে কেন পেলোনা সুরক্ষা!
পুত্র আমার হায় রে! বিধির কেমন
বিচার! রাঘব ক্ষুদ্র নয় বলে মন,
যাঁর নামে শিলা ভাসে সমুদ্র মাঝার
ঈশ্বরীয় হবে কেউ ঐশ্বর্য অপার।
বশিভূত কপি জাতি করছে সমর,
মানুষ নয় দেব সে, নিশ্চিত অমর।
হয় যদি দেবতা সে ভাগ্যবান মানি,
ভগবান হস্তে বধ সদা শুভ জানি।